আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না?
জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন আবেগ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ হঠাৎ খুব রেগে যায়, খুব ছোট কোনো ব্যাপারে ভেঙে পড়ে, খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম শুরু করে বা না ভেবে আত্মহত্যার মতো কাজ করতে যায়। এক–দুবার এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বারবার যদি এমনটা হতে থাকে; যদি এটা আমাদের সিদ্ধান্ত, সম্পর্ক বা নিজের পরিচয় নিয়েই সন্দেহ তৈরি করে, তাহলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। এর পেছনে থাকতে পারে একধরনের মানসিক সমস্যা, যাকে বলে ইমোশনাল ডিজরেগুলেশন, অর্থাৎ আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা।
এই সমস্যার কিছু লক্ষণ
ইমোশনাল ডিজরেগুলেশন হলে ব্যক্তির আবেগ ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। বাইরে থেকে তাঁকে স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে তিনি অস্থিরতায় ভোগেন। ছোট একটা ঘটনাও তাঁকে ভীষণ কষ্ট দিতে পারে। সামান্য চাপেই ভেঙে পড়তে পারেন।
এর সঙ্গে দেখা যেতে পারে
অতিরিক্ত উদ্বেগ বা লজ্জা
হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া
মাদক বা নেশাদ্রব্যের প্রতি আসক্তি
বিপজ্জনক যৌন আচরণ
সম্পর্কের টানাপোড়েন
খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন
আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা
সময়মতো এই সমস্যা ধরা না পড়লে এটা ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, এমনকি কর্মস্থল বা শিক্ষাজীবনেও খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। চিকিৎসা না করালে দীর্ঘ মেয়াদে এই সমস্যার প্রভাব আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
ইমোশনাল ডিজরেগুলেশনের কারণ
আবেগ তো আমাদের সবারই থাকে। তবে সেগুলো যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন এর পেছনে কিছু গভীর কারণ থাকতে পারে। অনেক সময় সেই কারণগুলো আমাদের শৈশব থেকেই শুরু হয়।
১. শৈশবের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
শৈশবে কোনো ভয়ংকর বা নাড়িয়ে দেওয়া ঘটনা—যেমন শারীরিক নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা বা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে গেলে তার প্রভাব দীর্ঘদিন থেকে যায়। কারণ, এই সময়টিই মানুষের মানসিক আর আবেগগত বিকাশের সবচেয়ে সংবেদনশীল ধাপ। এ সময়ের ট্রমা–পরবর্তী জীবনে আবেগের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে।
২. অবহেলা আর উপেক্ষা
শিশুর প্রতি অবহেলাও একধরনের নির্যাতন। যখন মা–বাবা বা অভিভাবক শিশুর প্রয়োজনীয় যত্ন, নিরাপত্তা, ভালোবাসা বা সঠিক দিকনির্দেশনা দেন না, তখন সেটি শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলে। পোশাক, খাবার, শিক্ষা বা আবেগগত চাহিদা—সবকিছু থেকেই সে বঞ্চিত হয়। এর প্রভাব পড়ে তার মানসিক গঠনে।
৩. মস্তিষ্কে আঘাত
গুরুতর মাথায় আঘাত পেলে কখনো কখনো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতায় সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি। এর ফলে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৪. দীর্ঘদিন ধরে অবমূল্যায়ন
কারও ভাবনা, অনুভূতি বা কথাকে বারবার গুরুত্ব না দেওয়া বা তুচ্ছ করে দেখা একসময় মানসিক অবমূল্যায়নের রূপ নেয়। এতে মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থ ঠিকভাবে কাজ করে না। মানুষ তখন প্রায়ই ‘লড়ো বা পালাও’ (ফাইট অর ফ্লাইট) ধরনের মানসিক অবস্থায় থাকে। এর ফলে আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মস্তিষ্কের যে অংশটি কাজ করে—প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্স—তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
ইমোশনাল ডিজরেগুলেশন-সম্পর্কিত মানসিক সমস্যা
আবেগের ভারসাম্য হারানোটা অনেক সময় বড় কোনো মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত। নিচে এমন কিছু মানসিক সমস্যা তুলে ধরা হলো, যেগুলোর সঙ্গে ইমোশনাল ডিজরেগুলেশনের সরাসরি যোগ আছে।
১. পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)
ভয়াবহ বা প্রাণঘাতী কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এই অবস্থা থেকে তৈরি হতে পারে পিটিএসডি। এতে অতীত ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি বারবার মনে পড়ে (ফ্ল্যাশব্যাক), দুঃস্বপ্ন, চরম উদ্বেগে ভোগেন ব্যক্তি। অনেক সময় বাস্তবতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। সব মিলিয়ে আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন, সম্পর্ক এবং কাজের জায়গাতেও এর প্রভাব পড়ে।
২. বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার (বিপিডি)
এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের আবেগ, চিন্তা, আচরণ ও সম্পর্ক ঠিকভাবে সামলাতে পারেন না। খুব অল্প সময়েই মুড বদলে যায়—একসময় হাসছেন, পরক্ষণেই কাঁদছেন বা রেগে যাচ্ছেন। প্রায়ই মনে হয় সবাই তাঁকে ছেড়ে যাবে, এবং সেই ভয় থেকে জন্ম নেয় আত্মহত্যার চিন্তা বা আত্মবিনাশী আচরণ। এ ধরনের মানুষদের মধ্যে মুড ডিজঅর্ডার, ইটিং ডিজঅর্ডার কিংবা মাদকাসক্তি দেখা দিতে পারে। ফলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।
৩. ফ্রন্টাল লোব ডিজঅর্ডার
মস্তিষ্কের সামনের অংশ, অর্থাৎ ফ্রন্টাল লোব যদি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন আসে, মানুষ না ভেবে কাজ করে ফেলে, মনোযোগে ঘাটতি দেখা দেয়, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি কোনো কাজ শুরু করার আগ্রহও কমে যায়। মাথায় আঘাত, স্ট্রোক, ইনফেকশন, ক্যানসার বা স্নায়বিক রোগের কারণেও হতে পারে এই সমস্যা।
৪. অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি)
ওসিডিতে আক্রান্ত ব্যক্তির মাথায় একধরনের অপ্রয়োজনীয় বা দুশ্চিন্তাজনক ভাবনা ঘুরতে থাকেন। সেই চিন্তা তাঁকে কিছু কাজ বারবার করতে বাধ্য করে—যেমন বারবার হাত ধোয়া, তালা চেক করা ইত্যাদি। এর পেছনে থাকে মস্তিষ্কের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বে থাকা অংশের (প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্স) কার্যক্ষমতার ব্যাঘাত।
আবেগ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে করণীয় কী
কিছু উপায় আছে, যা মেনে চললে ধীরে ধীরে আবেগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
কথা বলা ও কাউন্সেলিং
আবেগের জট খুলতে সাহায্য করতে পারে একজন পরামর্শক বা থেরাপিস্ট। বিশেষ করে কগনিটিভ বিহেভিয়োরাল থেরাপি (সিবিটি) নামের একটি থেরাপি রয়েছে, যা ধাপে ধাপে শেখায়—কীভাবে নিজের আবেগ বোঝা যায়, গ্রহণ করা যায় এবং সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এই থেরাপিতে নিজের আবেগ ধীরে ধীরে সামলানোর কৌশল শেখানো হয়।
ওষুধের সাহায্য লাগতে পারে
কখনো কখনো চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণের দরকার হতে পারে। ব্যক্তির মানসিক অবস্থা ও উপসর্গের ধরনের ওপর এটি নির্ভর করে। মনে রাখতে হবে, ওষুধ কখনোই নিজে থেকে শুরু করা উচিত নয়—বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে ভালো।
খাবার আর ব্যায়াম দিয়ে শুরু হোক ভালো থাকা
মন ভালো রাখতে শরীরের সুস্থতাও জরুরি। পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি পান আর প্রতিদিন একটু হাঁটাহাঁটি কিংবা হালকা ব্যায়াম মানসিক চাপ কমায়। এতে ঘুমও ভালো হয়, যা আবেগ নিয়ন্ত্রণে অনেক সাহায্য করে।
আবেগ চেনার অভ্যাস
নিজের আবেগগুলো আগে চিনতে হবে—রাগ, ভয়, কষ্ট কখন কীভাবে আসছে, তা বুঝতে পারলে নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। এই জন্য থেরাপির মাধ্যমে ধাপে ধাপে শেখা যায়, কীভাবে তীব্র আবেগে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজেকে স্থির রাখা যায়।
ভেতরের সমস্যাগুলো খুঁজে দেখা
অনেক সময় মনে হয় কেবল মানসিক চাপ, কিন্তু ভেতরে কোনো শারীরিক সমস্যাও লুকিয়ে থাকতে পারে—যেমন থাইরয়েড, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা বা অন্য কিছু। তাই প্রয়োজনে চিকিৎসকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নেওয়া ভালো।
নতুন কিছু শিখলে মনও হালকা হয়
নতুন কিছু শেখা, নিজের আগ্রহের জায়গায় মন দেওয়া কিংবা দীর্ঘদিনের ইচ্ছা পূরণে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া—এসবই আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। আত্মবিশ্বাস বাড়লে আবেগও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সূত্র: ওয়েবএমডি